নীললোহিতের চিঠি

পূর্ণতা (আগষ্ট ২০১৩)

রনীল
মোট ভোট ৫০ প্রাপ্ত পয়েন্ট ৫.৯
  • ৩৫
  • ১১৯
নীললোহিতের চিঠি
রনীল


“উত্তরণ” (১)
শহরের এদিকটা জনবসতি নেই বললেই চলে। সারিসারি পোড়ো বাড়িগুলোর মধ্য দিয়ে মাঝে মধ্যে দুই একটা বেওয়ারিশ কুকুর হেঁটে চলে যায়। ভুতে ধরা মৃত নগরীতে সেটিই একমাত্র প্রাণের লক্ষণ।

শহরের শেষ মাথায় একটি কারখানার সামনে এসে নেলসন থামলো। জেনারেল ডসেমন্ডরে সৈন্যরা এদিকে খুব একটা আসেনা। তবুও নেলসন সন্ধ্যা হবার জন্য অপেক্ষা করলো। সূর্য ডোবার পরপরই কর্পোরেশনের সস্তা বাতিগুলো মনের ভুলেই যেন জ্বলে উঠলো। নেলসনের কপালে বিরক্তির ছাপ পড়ে-
যুদ্ধ বিধ্বস্ত এমন মৃত একটি শহরে কে এমন নিয়ম মেনে বাতি জ্বালায়। নাকি এই বাতিগুলো নির্দিষ্ট সময়ে স্বয়ংক্রিয় ভাবেই জ্বলে ওঠে!

মৃদু নাক ডাকার শব্দ আসছে। মাদিবা বোধহয় নেলসনের কাঁধে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। কর্পোরেশনের বাতির আলোর গোরস্থানটি বেশ পরিষ্কারই দেখা যাচ্ছে। এতক্ষণ অপেক্ষা করেও কোন ফায়দা হল না।

নেলসন মাদিবার বাহু ধরে হালকা নাড়া দিতেই তিনি সজাগ হলেন। মাথার ব্যান্ডেজটা আর নতুন করে ভিজে ওঠেনি, তবে রক্তক্ষরণরে কারণে লোকটা বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। তার উপর গত দুদিন ধরে খেয়ে না খেয়ে বনে বাদাড়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে।

নেলসন নিজেও এই দুইদিন প্রায় কিছুই খায়নি। ক্লান্তিতে তার নিজের শরীরও ভেঙ্গে পড়বে যেন। কিংস্টনের গতকালের সংঘর্ষে ওরা প্রায় নি:স্ব হয়ে গেছ। দলের অধিকাংশ সদস্যই জেনারেলের পাতা ফাঁদে ধরা পড়েছে। যারাই প্রতিরোধের চেষ্টা করেছে জেনারেলের সৈন্যরা তাদরে গুলি করে মেরেছে।

এথিলিষ্টরা যে বিশ্বাসঘাতকতা করবে এমন একটা সন্দেহ মাদিবা আগেই করেছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তার আর কিছুই করার ছিলনা।

এখানে আর এভাবে বসে থাকার কোন মানেই হয়না। উঠে দাড়াতে গিয়ে যন্ত্রণায় মাদিবার মুখ কুঁকড়ে গেল। মর্টারে গোলার আঘাতে তার মাথার ডান পাশটা প্রায় উড়ে গেছে। ডান চোখটাও বোধহয় এবার গেছে। বাম পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে কিভাবে ব্যথা পেয়েছেন সেটা তিনি জানেননা।

উপায় না দেখে নেলসন মাদিবাকে কাঁধে তুলে নেয়। খরগোসের মত দ্রুত পায়ে কারখানাটি পার হয়ে নেলসন ঢুকে পড়লো ওপাশে দোতালা বাড়িটিতে। বাড়ির মালিক বৃদ্ধ মহিলাটি আগে থেকেই নেলসনকে চিনতেন।

তবে এমুহূর্তে নেলসনের এমন ঝুঁকি নিয়ে আসাটাকে তিনি পছন্দ করলেন না। বৃদ্ধার তোবড়ানো মুখের দিকে এক পলক তাকিয়েই নেলসন সেটি বুঝে ফেলে, কিন্তু এছাড়া তার সামনে আর কোন পথই খোলা নেই।

জেনারেলেরে সৈন্যরা শহরের প্রতিটি গলি ঘুপছি হন্যে হয়ে ঘুরে ফিরছে মাদিবার সন্ধানে। মাদিবার এখন যে অবস্থা তাতে তিনি পায়ে হেটেও বেশী দুর যেতে পারবেননা।
ঘাড় থেকে ভারী দেহটি নামাতে গিয়ে নেলসন টের পেল মাদিবা আবার জ্ঞান হারিয়েছেন।

জীর্ণ তক্তপোষের উপর ভারী দেহটি শুইয়ে দিয়ে নেলসন দুহাত জড়ো করলো
- এ লোকটার বেঁচে থাকা পুরো দেশের জন্যে জরুরী। যেকোনো মূল্যে একে রক্ষা করবেন, সুযোগ পেলেই আমি ফিরে আসবো, ততদিন পর্যন্ত ...
নেলসন অনুনয়ের দৃষ্টিতে বৃদ্ধার দিকে তাকায়। বৃদ্ধার মুখের বিরক্তিভাবে তাতে বিন্দুমাত্র কমেনা। অচেতন মাদিবার কপালে একটুখানি হাত বুলিয়ে দিয়েই নেলসনে মিশে গেল রাতের অন্ধকারে ...

“জননী” (২)
মাদিবা লোকটা একসময় বেশ সুদর্শনই ছিলেন। দীর্ঘদিনের বেপরোয়া আর অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কারণে সেসব এখন অতীত, নেলসন চলে যাবার পর জামিলা কিছুক্ষণ চুপচাপ মাদিবার মাথার পাশে বসে রইলেন। জামিলার বয়স আশি ছুঁই ছুঁই। তার জন্মের সময় এদেশ স্বৈরাচারের দখলে ছিল আর এখন প্রায় চলে যাবার সময় হয়ে এসেছে। স্বৈরাচারের জায়গায় স্বৈরাচার আসে, অশীতির এই বৃদ্ধাটি তার জীবনে কখনো মুক্ত দেশের বাতাসে নি:শ্বাস নিতে পারলেননা।

চেষ্টা তো কম হলোনা। জামিলার স্বামীর গত ত্রিশ বছর ধরে কোন সন্ধান নেই। তার বড় ছেলেকে জেনারেলের সৈন্যরা কুকুরের মত গুলি করে মেরেছে, ছোট ছেলেটাও মাদিবার দলে নাম লিখিয়েছে বহুদিন হল।

তবে এটা ও সত্যি, গত কয়েক দশকের অন্যান্য আন্দোলনের তুলনায় তার সামনে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে থাকা এই লোকটি শাসক গোষ্ঠীর বুকে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি দিতে সক্ষম হয়েছেন। তবে শেষ রক্ষা হলনা। পূর্ববর্তী অন্যান্য আন্দোলনের মতো এবারও বিশ্বাসঘাতকরা তাদের মাতৃভূমিকে শত্রুর কাছে বিক্রি করে দিয়েছে।

মাদিবার মত এমন নেতা আবার কবে আসবেন কে জানে! ততদিন পর্যন্ত কি এই লড়াই, মৃত্যু আর পাশবিকতা চলতেই থাকবে? ছোট ছেলেটির কি আর ঘরে ফেরা হবে না!

মাদিবার মাথার ব্যান্ডেজটা আবার রক্তে ভিজে যাচ্ছে। জামিলা তা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলেন। এ যুদ্ধের ফলাফল অনেক আগেই লেখা হয়ে গেছে। এ লোকটা অহেতুকই গোঁয়ার্তুমি করে যাচ্ছেন ...
...
সময়টি ঠিক সন্ধ্যা নয়, আবার একে কোনভাবে প্রভাত ও বলা যাচ্ছেনা। রোগাক্রান্ত সূর্যের পাণ্ডুর আলোর সাথে মিশে ইলশে বৃষ্টি মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে নদীর ওপারেই আরেকটা সূর্য দেখা যাচ্ছে। অপার্থিব আলোর সেই ব্যাপক সূর্যকে ঘিরে রীতিমত মেলা বসেছে সেখানটায়।

অনেক দৌড়ঝাঁপ, অনেকটা পথ হেটেও তিনি নদীর ওপাড়টায় যেতে পারলেন না। এপারের জলভূমিটা যেন এক গোলক ধাঁধা। বা পায়ের বুড়ো আঙ্গুলটায় প্রচণ্ড ব্যথা। জুতোর ভেতর জলকাদা ঢুকে একাকার হয়ে গেছে।

উবু হয়ে তিনি জুতো খুলতে যেতেই দক্ষিণের জঙ্গল ফুড়ে উদয় হল বিশালাকার এক ঘোড়া। ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে সেটি তার দিকে তেড়ে আসতেই তিনি পড়িমরি করে ছুটলেন পশ্চিমে। কিছুদূর যেতেই তার মনে হল সামনের মানুষ সমান উঁচু ঘাসগুলো কেমন যেন নড়ে উঠলো। তীব্র গতিতে সেদিক থেকে তেড়ে আসছে দানব আকৃতির আরেকটি ঘোড়া ...
মাদিবার ঘুম ভাঙ্গল শেষ রাতের দিকে। পুরানো তক্তপোষের ছারপোকাগুলো তাকে প্রায় ছিবড়ে করে ফেলেছে। তবে ঠিক সে কারণে তার নিদ্রা ভঙ্গ হয়নি। মাদিবা অধৈর্য হলেননা। আগের মতোই নিথর হয়ে পড়ে রইলেন তক্ত পোষটির উপর। ছারপোকার দল টেরই পেলনা লোকটার ঘুম ভেঙ্গে গেছে।

কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর মাদিবা কাঠের সিঁড়িতে সতর্ক পায়ের শব্দ শুনতে পেলেন। নাতিদীর্ঘ ক্লান্তিকর দাবা খেলায় রাজা অবশেষে কোণঠাসা হয়ে গেছেন। এমন দীনহীনের মতো করে এতোবড় যুদ্ধ লড়ার কোন মানেই হয়না।

প্রায় দুই যুগ ধরে লড়াইয়ের পর আফ্রিকান বিপ্লবরে প্রাণপুরুষ অগাস্টাস মাদিবা অবশেষে ধরা পড়লেন। প্রেসিডেন্টের সৈন্যরা যখন স্ট্রেচারে করে মাদিবাকে নিয়ে যাচ্ছিল- তখন আড়াল থেকে জামিলা বের হয়ে এলেন, এ জীবনে তো আর দেখা হবেনা ...
শিকলে বন্দী পরাজিত সম্রাট দেখলের তার আশ্রয়দাত্রীর চোখে এখন আর বিরক্তির ভাবটুকু নেই, বরং মনস্তাপে তাতে ভর করেছে এক শ্রাবণের বর্ষা ...

“অন্ধকূপ” (৩)
জেনারেলের হেডকোর্য়াটারে কতদিন কেটেছে সে সম্পর্ক মাদিবার কোন ধারনাই নেই। পাথুরে কারাগারে দিনের আলো কখনো প্রবেশ করেনা। অনেক উপর টিমটিমে বাতিটা নাছোড়বান্দার মতো জ্বলছে তো জ্বলছেই।
ভারী দরজার ফোঁকর দিয়ে যে লোকটা খাবার দিতে আসে সে খুব সম্ভবত বাকশক্তিবিহীন। মাদিবা তার সাথে কখনো কথা বলার চেষ্টা করেননি, লোকটিও কখনো সে চেষ্টা করেনি। তবে এ ব্যাপারটি তিনি কিভাবে যেন টের পেয়ে গেছেন। এসব ব্যাপার তিনি কিভাবে যেন টের পেয়ে যান...

বোবা প্রহরীটি দিনে একবার খাবার দিতে আসে, সে হিসেবে মাদিবা দিনের হিসেব রাখছিলেন। তবে কদিনের মধ্যেই তার হিসেব গোলমাল পাকিয়ে গেল।
সবকিছু এতো ঢিমেতালে চলছে যে মাদিবা ঠিক আশ্বস্ত হতে পারেননা। জেনারেলের চালে কখনো ভুল হয় না। তার চেয়ে বড় কথা জেনারেল কখনো এভাবে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার লোক না।

এতদিনে বোবা প্রহরীটি ছাড়া কেউই মাদিবার সাথে দেখা করতে আসেনি। কেউ-কি কোন গোপন রন্ধ্র দিয়ে মাদিবার উপর নজর রাখছে? যদি রেখেও থাকে বোঝার কোন উপায় নেই।
নি:সঙ্গতার চেয়ে বড় শাস্তি মানুষের জন্যে আর কীইবা হতে পারে। সময়ের হিসাবে গোলমাল করার পর মাদিবা অনুভব করেন তার প্রতিরোধ দুর্বল হয়ে আসছে। এরা খাবারে কিছু মিশায় কিনা কে জানে! মাদিবা টের পান। তার চেতনা ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে।
দরজার পাশে খাবারের পাত্রগুলো জমতে থাকে। ভাঙ্গাচোরা খাটায় শুয়ে থাকা মাদিবা একসময় ভুলে যান তিনি কে। চোখদুটো বুজে আছে, নি:শ্বাস ও অতি মৃদু, হৃদয়টা মাঝে মাঝে মস্তিষ্কে রক্ত পাঠাতে ভুলে যাচ্ছে।

বোবা প্রহরীটি খাবারের পাত্রটি নামিয়ে রেখে দরজার ওপাশে ভাবলেশহীন মুখে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকে, তারপর চলে যায়। এই বাইরে কোন কিছু করার ক্ষমতা তার নেই।

কারাগারের অন্য সবাই ভাবলো জেনারেল কি মাদিবার কথা ভুলেই গেলেন নাকি? যারা এমনটা ভাবছিল তারা এতদিনেও জেনারেলকে ঠিক চিনতে পারেনি। কোনরূপ অত্যাচার হয়নি, কোন প্রতিরোধের ও ব্যাপার নেই স্রেফ নিঃসঙ্গতা দিয়েই জেনারেল মাদিবাকে ভেঙ্গে ফেললেন।
এরপর দরজাটা একদিন ঘটাং করে নড়ে উঠলো। কজন উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা কামরায় প্রবেশ করে কিছুক্ষণের জন্যে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন।

কাছে গিয়ে দেখা গেল লোকটার জ্ঞান আছে। তবে নি:শ্বাস অনিয়মিত। অপ্রকৃতস্থরে মতো মাদিবা ঘাড় ঘুরিয়ে ছায়ামূর্তিগুলোকে দেখার চেষ্টা করেন। দায়িত্বে থাকা সেনা-কর্মকর্তাটি আলতোভাবে মাদিবার নাড়ি পরীক্ষা করে দেখেন-

- মাদিবা আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?
কতদিন পর মানুষের কণ্ঠস্বর শুনলেন মাদিবা জানেন না। এই লোকটি এসেছে মাদিবাকে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা সবগুলো মামলার রায় শোনাতে। কবে কোথায় এসব মামলা দায়ের হয়েছে, কি অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে সে সম্পর্কে মাদিবার কোন ধারনাই নেই।

জেনারেল ডেসমন্ড ভেবেছেন আত্মপক্ষ সমর্থন কিংবা যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের মতন ব্যাপারগুলো এখানে অহেতুক, নিত্যপ্রয়োজনীয়। এতোটা কেউ অবশ্য তার থেকে আশা করেনি, স্বয়ং মাদিবাও নন।

- মাদিবা আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?
- হু ...
- দেশদ্রোহিতা, হত্যা এবং লুণ্ঠনসহ আপনারা বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ এবং অপরাধ বিবেচনা করে মাননীয় আদালত আপনাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। তবে মহানুভব প্রেসিডেন্ট তার বিশেষ ক্ষমতাবলে আপনার মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দিয়েছেন। এই দণ্ড কার্যকর করা হবে রোবেন দ্বীপে। আপনি কি এখন উঠে বসতে পারবেন?
এক নির্বাসন থেকে আরেক নির্বাসনের দণ্ড! রোবেন দ্বীপে আর যাইহোক কথা বলার লোক পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই। মাদিবা খোলা দরজা দিয়ে আসা একটুকরো রোদের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকেন।


“লাইটহাউজ” (৩)
কারাগারটি দেখতে অনেকটা বাতিঘরের মতো। সত্যি কথা বলতে, এটি এক সময় বাতিঘর হিসাবেই ব্যবহৃত হত। তবে সেটি অনেকদিন আগের কথা।

আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার পর ভিনদেশী জাহাজগুলো এইপথে আসা যাওয়া এক প্রকার বন্ধই করে দিয়েছে। মাঝে মধ্যে দুই একটা জলদস্যুর দল পথ ভুল করে এদিকে চলে আসে, তবে নৌ বাহিনীর তাড়া খেয়ে বেশীক্ষণ তিষ্ঠোতে পারেনা।

সিলিন্ডার আকৃতির কারাগারটির একদম উপরের প্রকোষ্ঠটি বরাদ্দ হয়েছে মাদিবার জন্যে। মেঝে থেকে দশ-বারো ফুট উপরে একটি মাত্র জানালা। ছোট একটুকরো সেই জানালাটিই ক্রমান্বয়ে মাদিবার সকল মনোযোগ কেড়ে নিল।

গভীর রাতে সেই লোহার গরাদ বসানো জানালাটি দিয়ে সাগরের হাওয়ারা হু হু করে প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করে। মাঝে মাঝে তাতে যোগ দেয় চাঁদের আলো। কখনো কখনো অনেকদূর থেকে নি:সঙ্গ একটি তারা লাজুক ভঙ্গিতে উকি মেরে পরক্ষণেই সরে পড়ে।

সেদিক তাকিয়ে মাদিবার পেছনের জীবনের কথা মনে পড়ে যায়। জীবনের একটা বড় সময় তার কেটে গেছে বনে জঙ্গলে, পথে পথে। তাড়া খাওয়া জন্তুর মতো আঁধার বনে ঘাপটি মেরে পড়ে থেকেছেন বহুদিন। কখনো এমন নিবিড়ভাবে আকাশের দিকে তাকানো হয়নি। আজ যখন সময় পেয়েছেন তখন পুরো আকাশটাই যেন মাথার উপর থেকে গায়েব হয়ে গেছে।

কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য মাদিবার সম্পূর্ণ আকাশ দেখার সাধ পূর্ণ হল। পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে বুঝতে পেরে কারাগার কর্তৃপক্ষ মাদিবাকে তার নি:সঙ্গ প্রকোষ্ঠটি থেকে বের হবার অনুমতি দিল। সকাল দশটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত মাদিবা নিচে নামতে পারবেন। গতিবিধিতে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ থাকবে, এর মাঝেই স্নান, দুপুরের খাবার এবং বাগান পরিচর্যার কিছু কাজ করতে হবে।
প্রকোষ্ঠ হতে বের হয়ে মাদিবা এ প্রথম কারাগারের অন্যান্য বন্দীদের সাথে মেশার সুযোগ পেলেন। কারাগারে বন্দীর সংখ্যা হাতে গোনা। দীর্ঘদিনের কারাবাসরে কারণে এসব বন্দীদের মাঝে একটা নিরাসক্তভাবে চলে এসেছে। এদের প্রায় সবাই বিশ-ত্রিশ বছর ধরে এখানে বন্দী হয়ে আছেন। কেউই মাদিবাকে সেভাবে চিনলেন না।
কারাকর্তৃপক্ষ বন্দীদের কোন চিঠি কিংবা পত্রিকা সরবরাহ করেনা। যে কারণে গত বিশ-ত্রিশ বছরে বাইরের পৃথিবীতে কত কি ঘটে গেছে সে সম্পর্কে এদের কোন ধারনাই নেই।

এদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী যে লোকটি, তার নাম জেফারসন। মাদিবার পাশরে গ্রামেই বাড়ি। লোকটি বোধহয় মাদিবাকে একটু চিনতে ও পারলো।

দুপুরের খাবারের সময় মাদিবা জেফারসনের সাথে ভাব জমাতে চান। প্রেসিডেন্ট ডেসমন্ডের বিরুদ্ধে তাদের দীর্ঘদিনের সংগ্রামের একটা সংক্ষিপ্ত ধারনা দিতে চান।

অশীতপির বৃদ্ধটি মাদিবাকে মাঝপথে রুক্ষভাবে থামিয়ে দেন।
- কি হবে এসব আর আলাপ করে? যুগ যুগ ধরে স্বৈরাচাররা সবকিছু চুষে খাচ্ছে। কালোদের দাস হিসেবে মাগনা খাটাচ্ছে। আর আমরা যারা ন্যায়ের কথা বলতে চেয়েছি তারা সবাই এমন জেলে পচে মরছি। ঈশ্বরই যেখানে এতো বড় অবিচার মেনে নিয়েছেন সেখানে আমাদের অহেতুক কথা বলার কোন মানে হয়!

বুদ্ধের গলারস্বর একটু চড়ে গিয়েছিল, সেটি শুনে দীর্ঘদেহী প্রহরীটি চাবুক হাঁকিয়ে এগিয়ে আসে। এই বৃদ্ধরা যে সংগ্রামের শুরু করেছিলেন, মাদিবা সেটি এতদিন টেনে বেড়িয়েছেন। এদের মতো মাদিবার শেষমেশ স্থান হয়েছে পাথুরে এই কারাগারে। তাহলে এতদিন ধরে চালানো এই সংগ্রামের পুরোটাই কি বৃথা গলে!

অন্ধকার টানেলের শেষ মাথার এক টুকরো আলোর মতো লেনসনের কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল। মাদিবা বিয়ে করেননি, তার কোন সন্তান নেই। কিন্তু নেলসনের মতো এমন অসংখ্য যুবার বুকে মুক্তির আগুন জ্বালাতে তিনি সক্ষম হয়েছেন।

এই বৃদ্ধটি ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি নিজেও আটকা পড়ে গেছেন পাথুরে দ্বীপে। কিন্তু নেলসনের মতো টগবগে যুবকগুলোরও এমন পরিণতি হবে এমনটা তিনি ভাবতেই পারছেন না।

প্রকাণ্ড সূর্যটা শেষ বিকেলে নিশ্চিতভাবেই সাগরে ডুবে যাবে। কিন্তু নি:সঙ্গ তারাটি যতদিন মাদিবার জানালায় হাজিরা দিয়ে যাবে, ততদিন পর্যন্ত তিনি আশা ছাড়ছেন না, কিছুতেই না!



“রন্ধ্র” (৫)
এরপর সময় নিজ গতিতে বয়ে যেতে লাগলো। কারাগারের বুড়োগুলো ক্রমান্বয়ে আরো বুড়ো হয়ে যেতে লাগলো। মাদিবা দীর্ঘদিন আয়নায় চেহারা দেখেননি। তবে দুপুরের খাওয়া শেষে মাঝে মধ্যে কাসার থালাখানি উল্টে সেখানে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকেন। বুড়োগুলো সেটি দেখে হতাশ ভাবে মাথা নাড়ে।
মাদিবার সময়ের কোন হিসেব রাখেননি। দেয়ালে দাগ কাটলে প্রহরীগুলো নৃশংসভাবে চাবুক দিয়ে মারে। তাছাড়া সময়ের কথা ভাবলে সেটি উল্টো ভারী হয়ে মনের মাঝে চেপে বসে। মাদিবা তাই এব্যাপারটি পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছেন।

এতো পরিশ্রম, এতো অযত্নতেও বুড়োগুলো বহাল তবিয়তে বেচে রইলো, মরে গেল বরং কারাপ্রধানটি। কারাপ্রধানের মৃত্যুর পর কারাগারের শৃঙ্খলার ব্যাপারটি কিছুটা শিথিল হয়ে এলো। পাথুরে চেহারার প্রহরীগুলোর মুখে কিছু ফুর্তিও ভাব দেখা গেল। গভীর রাতে মাতাল প্রহরীগুলোর জড়ানো কণ্ঠস্বর শোনা যায়। এতে করে মাদিবাদরে অবশ্য কোন লাভ হলোনা।

প্রয়াত কারাপ্রধানটি নিষ্ঠুর হলেও শৃঙ্খলা মেনে চলতেন। অকারণে কাউকে কখনো নির্যাতন করেননি। তার অবর্তমানে মাতাল প্রহরীগুলো বিনা কারণে বুড়োগুলোকে মারধর শুরু করলো। পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছিল। এমন সময় একদিন রোবেন দ্বীপের কারাবন্দীদের নিস্তরঙ্গ জীবনে এক চমকপ্রদ ঘটনা ঘটে গেল। প্রায় বিনা নোটিশে জেনারেল ডেসমন্ড একদিন কারা পরিদর্শনে এসে হাজির হলেন রোবেন দ্বীপে।

অসতর্ক প্রহরীদের মাঝে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। মাদিবা তখন স্নানঘরে পরিষ্কার হচ্ছিলেন। এমন সময় কম বয়সী এক প্রহরী প্রায় বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে সেখানটায় উপস্থিত হল। হাতে খবরের কাগজে মোড়ানো দুটো মদের বোতল-তাসের প্যাকেট আর কিছু নেশাদ্রব্য। তড়িঘড়ি করে প্রহরীটি জিনিসগুলো ফেলে দিল স্নানঘরের শেষ মাথার সেপ্টিক ট্যাংকরে ভিতর।

প্রহরীটি চলে যাবার পর মাদিবা কম্ভিূত একটা কাণ্ড ঘটালেন। সবাই এখন প্রেসিডেন্টকে নিয়ে ব্যস্ত। ভুতগ্রস্থরে মতো মাদিবা হেটে গেলেন কামরার শেষ মাথায়, সেপ্টিক ট্যাংকটরি কাছে। বোতল দুটি তখন মাত্র ডুবতে শুরু করেছিল। দীর্ঘদিন এদিকটায় কোন মেরামত হয়নি। সেপটিক ট্যাংকটি উপচে পড়ছে বিষ্ঠা আর আবর্জনায়। নির্বিকার মুখে তাতে হাত ডুবিয়ে মাদিবা একটি বোতল তুলে আনলেও দ্বিতীয়টির নাগাল পেলেননা।

অদূরে দাড়িয়ে থাকা বৃদ্ধের দলের মাঝে গুঞ্জন উঠে। কেউ কেউ বিরক্ত হন, এদের কেউ কখনো-মাদিবার সুরাসক্তি কোন নমুনা দেখেননি।

তাদরে ভুল অবশ্য কিছুক্ষণের মাঝেই ভাঙ্গলো। মাদিবা খুব সতর্কভাবে প্যাকেট থেকে বোতলটি বের করলেন। তারপর প্রায় ধুয়ে যাওয়া হরফরে সে কাগজখানি ভাজ করে চট করে গুজে ফেললেন কোমরে।

“নীল লোহিত” (৬)

বিকেল বেলায় বন্দীরা কারাগারের প্রবেশের পরপরই সকল বাতি নিভিয়ে দেওয়া হয়। শেষ বিকেলের ম্লান আলোতেই মাদিবা তাই মহার্ঘ কাগজখানি খুলে বসলেন। কিংস্টনের সংঘর্ষে আহত হয়ে মাদিবার ডান চোখটি কার্যত নষ্ট হয়ে গেছে। আলোও দ্রুত মরে আসছে।
দীর্ঘদিন পর মাদিবা ধমনীতে রক্ত চলাচল টের পান। পাগলের মতো করে তিনি খুব দ্রুত ঝাপসা হয়ে যাওয়া হরফগুলোতে চোখ বুলিয়ে যান। প্রায় পুরো কাগজ জুড়ে কেবল প্রেসিডেন্টের প্রশংসা সুলভ কথাবার্তার। এর বাইরে উল্লখেযোগ্য কোন খবর নেই।
আশার আলো ক্রমশ নিভে যাচ্ছে। মাদিবা তবুও খবরগুলো খুঁটিয়ে পড়তে লাগলো। যদি কোন গুরুত্বপূর্ণ কিছু চোখে পড়ে।
এক জায়গায় এসে মাদিবার হৃদপিণ্ড হঠাৎ থেমে গেল যেন। কোন একটি প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসে জেনারেল ডেসমন্ড দাবী করেছেন রোবেন দ্বীপে মাদিবার নির্বাসন এবং তার প্রধান সহযোগী নেলসনের ফাঁসির রায় কার্যকর হবার পর দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়েছে. . .
ঘর ছেড়ে বের হবার পর শত প্রতিকূলতা- অত্যাচার সত্ত্বেও মাদিবা কখনো কাঁদেননি। নেলসনের মৃত্যুসংবাদ তার বুকে যেন মৃত্যুশেল বিধিয়ে দিল। মাদিবার বুকফাটা আহাজারিতে অন্য সেলের বৃদ্ধরা সচকিত হয়ে ওঠেন।

চৌকোণা জানালাটি দিয়ে সেই লাজুক তারাটি উঁকি দেয়নি বহুদিন হল। সবকিছু কি তবে শেষ হলে গেল! পুতিগন্ধময় দুটি হাতে কপাল চেপে ধরে মাদিবা আহাজারি করেন-

- বাপধন, আমাকে তুই মাপ করে দিস। তোর জন্য কখনো কিছু করতে পারলামনা, সারাজীবন শুধু কষ্টই পেলি . . . আমাকে তুই মাফ করে দিস. . .!

“চিঠি” (৭)
কারাগার পরিদর্শনে এসে প্রেসিডেন্ট ডেসমন্ড নানান অনিয়ম বিশৃঙ্খলা স্বচক্ষে দেখেছিলেন। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত কারাপ্রধান এবং বেশ কজন কারারক্ষীকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিলেন।

দেশে ফিরে গিয়ে তার দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত অনুচর কর্নেল আর্চারকে রোবেন দ্বীপে পাঠালেন কারাপ্রধানের দায়িত্ব দিয়ে। মাদিবার উপর কর্নেল আর্চারের বিদ্বেষ দীর্ঘদিনের। বহু দিন পূর্বে মাদিবা তার দলবল নিয়ে কর্নেল আর্চারকে রীতিমত নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিলেন।

রোবেন দ্বীপের দায়িত্ব পেয়ে কর্নেল আর্চার যেকরনে বেশ খুশিই হলেন। ভেবেছিলেন মাদিবাকে হাতের মুঠোয় পেয়ে এতদিনের জমানো সব ক্ষোভ ঝাড়বেন। কিন্তু এখানটায় এসে তিনি অন্য এক মাদিবার দেখা পেলেন। শুকিয়ে চিমসে মেরে গেছেন। জীর্ণ মলিন জামাকাপড়, মাথার চুল বাড়তে বাড়তে জটা পাকিয়ে গেছে।
সবচেয়ে বড় কথা শত অত্যাচার- নির্যাতনেও মাদিবার চোখের মাঝের যে আগুন কখনো নেভেনি, সে আগুন অবশেষে নিভে গেছে।

নেলসনের মৃত্যু সংবাদ পাবার পর মাদিবার এক প্রকার মস্তিষ্ক বিকৃতিই ঘটে গেছে। দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টাই জড়ধী হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থাকেন, শুকতারার সন্ধানেই হয়তো। এর মাঝেই গত কয়েক বছরে বেশ কটা বুড়ো টপাটপ মরে গেল। মাদিবার তাতেও কোন ভ্রূক্ষেপ নেই।

কর্নেল আর্চার এসে প্রথমেই মাদিবাকে সবচেয়ে পরিশ্রমের কাজগুলো দিলেন। মাদিবা তাতে কোন আপত্তি করেন না- যন্ত্ররে মতো করে তিনি পাথর ভাঙ্গেন, বোঝা বয়ে যান। কর্নেল আর্চারের ক্রোধ তাতে আরো বেড়ে যায়। কারণে অকারণে চাবুক মেরে তিনি রক্তাক্ত করে দেন মাদিবার দেহ।

অত:পর মাদিবাকে জব্দ করার জন্য তিনি নতুন একটি পরিকল্পনা করলেন। সিদ্ধান্ত হল কারাগারের সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্দেশ্যে একটি রাস্তা বানানো হবে, যেটি গিয়ে শেষ হবে দ্বীপের শেষ মাথায়। মাদিবার সাথে বৃদ্ধ জেফারসনের বন্ধুত্ব দেখে তাকেও একাজে নিয়োগ দিলেন কর্নেল আর্চার - বুড়ো জেফারসনের কষ্ট দেখে যদি মাদিবার কোন প্রতিক্রিয়া হয়।

জেফারসন ততদিনে শারীরিকভাবে একেবারেই অকর্মণ্য হয়ে পড়েছেন। বহুদিন পুরানো জমাট পাথরের চাইগুলোর সামনে সে অসহায়ভাবে দাড়িয়ে থাকে। মাদিবা এসে হাত না লাগালে সেগুলো নাড়াতেই পারেন না। বিশাল আকৃতির হাতুড়ি দিয়ে পাথরের চাইগুলো পিটিয়ে গুড়ো করতে করতে তাদের হাতের মুঠো ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল, কিন্তু থামার উপায় নেই। থামলেই নিষ্ঠুর প্রহরীগুলো নির্দয়ভাবে চাবুক দিয়ে পেটাবে।

ব্যথা সহ্য করতে না পেরে জেফারসন গায়ের জীর্ণ শার্টটি খুলে হাতে পেঁচিয়ে নেয়-তাতেও কোন লাভ হয় না। অত্যধিক পরিশ্রমে কদিনের মধ্যেই বৃদ্ধ জেফারসন পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়লো। একদিন সকালে প্রহরীদের বাঁশি শুনে সকল বন্দী তাদের নিজ নিজ কক্ষ থেকে বের হয়ে আসলো, কেবল জেফারসন ছাড়া। চাবুক হাঁকিয়ে প্রহরীর দল তার কামরায় যেতেই দেখতে পেলো জ্বরের ঘরে জেফারসন প্রলাপ বকছে। চ্যাংদোলা করে তাকে কামরা থেকে বের করে রেখে আসা হল তারই রক্ত আর ঘামে মাখামাখি প্রক্রিয়াধীন সে পথটির উপর।
জরতপ্ত জেফারসনের চোখ ফেটে যেন রক্ত বের হয়ে পড়বে। মাদিবা সেটি দেখেও দেখেন না। উন্মত্তের মতো করে তিনি ক্রমাগত পাথরের চাইগুলো গুড়ো করতে থাকেন।

নিষ্করুণ সূর্যের তীব্র দাবদাহনের মধ্যে দুজন উন্মাদ সদৃশ বৃদ্ধ বিরামহীনভাবে পাথর ভেঙ্গে যান। প্রকল্প শুরুর আগে কর্নেল আর্চার নিজেও কখনো ভাবেননি এ রাস্তা কখন সম্পূর্ণ হবে।

কিন্তু মাদিবার অমানুষিক পরিশ্রমে রাস্তার কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। বিগত জীবনরে সকল ব্যর্থতার শোধ যেন মাদিবা এভাবেই তুলতে চান।
নুড়ি বিছাতে বিছাতে মাদিবা একসময় প্রায় পৌঁছে যান তীরের কাছটায়। কিন্তু এতদিনের পরিশ্রমের শেষটা দেখা যেন হতভাগ্য জেফারসনের কপালে নেই। বেপরোয়া মাদিবার পায়ে সাগরের ঢেউ স্পর্শ করতেই জেফারসন লুটিয়ে পড়লো। মাদিবা সেদিকে একপলক তাকালেন তারপর দ্রুত হাতে নুড়ি ছড়িয়ে যেতে লাগলেন- এই রাস্তা শেষ করার চেয়ে আর গুরুত্বপূর্ণ যেন আর কিছুই হতে পারেনা।

শেষ পাথর খণ্ডটি ছড়িয়ে দিতেই নীল কাঁচের পেটমোটা বোতলটি মাদিবার পায়ে এসে ঠেকলো। মাদিবা ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। এ যেন নিয়তির খেয়ালী এক চিত্রনাট্যের শেষ অধ্যায়।
অনেক পূর্ণিমা, অনেক আঁধার রাত্রি এই পেটমোটা বোতলটি কাটিয়ে দিয়েছে ফুলে ওঠা সাগরের পেটে, ফসফাররে জটলায়। বহু রক্ত, বহু ঘাম ঝড়িয়ে মাদিবা সুদীর্ঘ পথটি পাড়ি দিয়ে সেখানটায় পৌছুতেই যেন বোতলটির প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হল।

সামনে ঝুঁকে মাদিবা বোতলটি তুলে ধরতেই দেখতে পেলেন এর ভেতরে খুব যত্নে একটি চিঠি তুলে রাখা আছে। মাদিবা আলতো হাতে চিঠিটি বের করে বোতলটিকে শুকনো বালুচরে শুইয়ে দেন। অর্পিত দায়িত্ব ঠিকঠাক শেষ হয়েছে, নিতান্ত অলস ভঙ্গিতে বোতলটি শুভ্র বালুচরে শুয়ে থাকে।

মাদিবার কোন পরিবার নেই। নেই প্রতীক্ষারত প্রেমিকা কিংবা কোন নিকট আত্মীয়। চিঠিটি লিখেছে তার সন্তানতুল্য নেলসনই . . .

প্রিয় মাদিবা,
এই চিঠি আপনার কাছে পৌঁছানোর সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তবুও কেন যেন মনে হচ্ছে চিঠিটি শেষমেশ আপনার কাছে পৌঁছেই যাবে। যতদূর জানি আপনাকে রোবেন দ্বীপে নির্বাসনে পাঠানো হবে। সেখান থেকে আপনার ফিরে আসার সম্ভাবনা এই বোতলের আপনার কাছে পৌঁছে যাবার চেয়েও ক্ষীণ। তবুও আমি হাল ছাড়ছিনা। দল প্রায় ভেঙ্গেই গেছে, সবাই যে যেদিকে পারে পালিয়ে যাচ্ছে।
তবে একটা ব্যাপার জেনে রাখুন- যে মুক্তির দিনের স্বপ্ন আপনি আমাদের মাঝে জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন সে স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত না করে আপনার ছেলে মরবে না।
আপনার সুস্থতা কামনা করছি, বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক...
পুত্র নেলসন।

দীর্ঘদিন ধরে মরে পড়ে থাকা বুড়ো গাছে যেন হঠাৎ প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। পেটমোটা সবুজ কাঁচের বোতলটি যেন সাতসাগর পারি দিয়ে মাদিবার জন্য মৃত্যুঞ্জয়ী আরক বয়ে এনেছে। একটু দূরে পড়ে থাকা জেফারসন যেন বিনা কারণেই মার খাচ্ছে। চিৎকার দিয়ে মাদিবা সেদিকে ছুটে যান। প্রহরীর দল মুহূর্তের জন্য ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। তারপর দ্বিগুণ উদ্যমে মাদিবার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

চাবুকের আঘাতে মাদিবার ক্ষতবিক্ষত সইে দৃষ্টিহীন চোখটি দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়তে থাকে। সফেদ বালুচরে রক্তাক্ত দুটো হাত চেপে ধরে আরো একবার তিনি নিজে নিজেই কথা বলেন
- চিন্তা করিসনা বাপধন! তোর স্বাধীন দশেরে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তর না করে তোর এই বুড়ো বাপ থামবোনা...
(তাকে আমি কখনো চোখে দেখেনি, কিন্তু তার অনেক লেখা পড়েছি। তাঁর লেখায় এতোটাই বুদ হয়ে ছিলাম যে তাঁর মৃত্যুতেও আমার খুব বেশি প্রতিক্রিয়া হলনা, তিনি যে অন্য কোথাও যাননা। তিনি রয়ে গেছেন তাঁর অজস্র কবিতা, উপন্যাস আর ছোটগল্পে। তিনি যে রয়ে গেছেন পাঠকের মস্তিষ্কের ভেতর, মননে। এই গল্পেও তাঁর উপস্থিতি রয়ে গেছে, বেশ প্রকট ভাবেই থেকেছে। আমি অবশ্য তাতে মোটেও বিব্রত হচ্ছিনা, শুধু পাঠকের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছ। আর ‘নীললোহতিরে চিঠি’ বোতলে ভরে ভাসিয়ে দিলাম সময়ের দরিয়ায়। একদিন না একদিন সেটি তার প্রাপকরে কাছে পৌছবেই... এ নিয়ে আমার মনে কোন দ্বিধা নেই... )
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ডা: প্রবীর আচার্য্য নয়ন অনেক অনেক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাই
ডাঃ সুরাইয়া হেলেন অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা..<3
ভালো লাগেনি ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
জায়েদ রশীদ অনেক অনেক অভিনন্দন... দারুণ লেখাটা স্বীকৃতি পেল। আর এক্সপেরিমেন্ট... ওটা আরও বেশি বেশি করবেন যেন আমরা উপভোগ করার সুযোগ পাই!
ভালো লাগেনি ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
ওয়াহিদ মামুন লাভলু অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।
ভালো লাগেনি ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
রক্ত পলাশ অভিনন্দন রনীল ভাই
ভালো লাগেনি ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
রওশন জাহান কাল রাতে অর্ধেক পড়ে আর শেষ করতে পারিনি বাসায় গেস্ট আসায়। কিন্তু মন পড়ে ছিল মাদিবার দিকে । দীর্ঘদিন পর কারো লেখার প্রতি এমন আকর্ষণ অনুভব করেছি।মনে হয়েছে কৈশোরের কোন অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীতে ডুবে গেছি । উচ্ছ্বসিত হলাম বিষয়বস্তু এবং লেখার স্টাইলে। এক কথায় অসাধারন। অভিনন্দন রইল।
ভালো লাগেনি ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

০৪ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩১ টি

সমন্বিত স্কোর

৫.৯

বিচারক স্কোরঃ ৩.৪ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ২.৫ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪